Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
আহসানগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন খোয়াড়ের ১৪৩১ বাংলা সনের ইজারা বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত

খোঁয়াড় হচ্ছে জমির ফসল অথবা বসতবাড়ির বাগান বিনষ্টকারী গবাদিপশু আটক রাখার গারদ বিশেষ। ফসল বিনাশ করার আশঙ্কা রয়েছে, এমন অবাধে বিচরণকারী গবাদিপশুও খোঁয়াড়ে আটক রাখার বিধান রয়েছে। বোধশক্তিহীন প্রাণীকে মানুষের বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি করা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অমানবিক মনে হবে। অথচ কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে খোঁয়ার থাকার বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের এই খোঁয়াড় ব্যবস্থার উদ্ভব কীভাবে? বাংলাদেশে কি এখনো খোঁয়াড়ের অস্তিত্ব আছে? কীভাবে চলছে এসব খোঁয়াড়? সেগুলো চালাচ্ছেই বা কারা?

চিন্তিত মুখে দাওয়ায় বসে আছে গফুর। মহেশের খোঁজ নেই। সারাদিন খোঁজার পর বাড়ি ফিরে আমিনা জানায় মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দেওয়া হয়েছে। শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' ছোটগল্পে এভাবেই উঠে আসে খোঁয়াড়ের কথা। কিন্তু এই খোঁয়াড় আসলে কী? এ যুগে কয়জনই বা খোঁয়াড়ের কথা জানেন?

নিম্নবর্গের সমাজ ব্যবস্থার উপেক্ষিত অনেক বিষয়ের মতোই খোঁয়াড় নিয়েও তেমন আলোচনা নেই। সহজ ভাষায় বললে খোঁয়াড় হলো গবাদি পশুর জেলখানা। শরৎচন্দ্রের মহেশ ছিল দরিদ্র গফুরের পালিত এক নিরীহ গরু। খাবারের আশায় অন্যের বাগানে ঢুকে গাছপালা নষ্ট করে মহেশ। বোধশক্তিহীন কোনো প্রাণী এমন কাজ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তাকে মানুষের আইনে শাস্তি দেওয়া কেমন বিধান?

বর্তমান প্রজন্মের কাছে খোঁয়াড় ব্যবস্থা অমানবিক মনে হবে। তবে এককালে খোঁয়াড়ের সঙ্গে কৃষকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা গ্রামাঞ্চলে  অভিজ্ঞরা হয়তো কিছুটা জানেন।

আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে খোঁয়াড় প্রায় বিলুপ্ত। অথচ কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে খোঁয়ার থাকার বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষই জানে না। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের এই খোঁয়াড় ব্যবস্থার উদ্ভব কীভাবে? বাংলাদেশে কি এখনো খোঁয়াড়ের অস্তিত্ব আছে? কীভাবে চলছে এসব খোঁয়াড়? সেগুলো চালাচ্ছেই বা কারা?

ঔপনিবেশিক খোঁয়াড় ব্যবস্থা

উপনিবেশবাদ কেবল মানুষ নয়, গৃহপালিত প্রাণীদেরও জিম্মি করেছিল। সাধারণত গবাদিপশু ফসলের ক্ষতি করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ওই পশুকে খোঁয়াড়ে দেন। এক্ষেত্রে যতদিন পশুর মালিক ফসলের ক্ষতিপূরণ না দিবে ততদিন পশুটিকে খোঁয়াড়ে আটকে রাখা হয়।

১৯ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার প্রথম গৃহপালিত প্রাণীর ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ১৮৭১ সালে জারি হয় গবাদিপশু অনধিকার প্রবেশ আইন।

তবে এই আইন মোটেই শুধু গবাদি পশুর কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। আইন প্রণয়নের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত, গবাদি পশুগুলো বন্য প্রাণীর আক্রমণের শিকার হতো। শুধু ১৮৯২ সালেই বার্মার ইরাবতীতে সাপ, কুমির ও বাঘের আক্রমণে ৬৮৬টি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়।

দ্বিতীয়ত, সেসময় গবাদি পশুর মড়ক ছিল ভয়াবহ বিষয়। ১৮৯৫ সালের মড়কে মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ে বাংলার সীমান্তে আকিয়াব জেলায় ১,৫৬৩টি পশু মারা যায়। এছাড়া কোনো গরু অসুস্থ হয়ে মারা গেলে তাদের যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা হতো। সেগুলোর সংস্পর্শে এসে অন্যান্য গরু-ছাগলও আক্রান্ত হতো।

তৃতীয়ত, সরকার বার্মা জাতের গরু সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। শক্তিশালী ও উন্নত প্রজাতির গরু হওয়ায় এদের সংকরায়ন রোধ করে প্রজাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করা হয়।

সংকরায়ন রোধ ও গবাদি পশুর উচ্চ মৃত্যুহারের কারণ অনুসন্ধানে মানুষের অসচেতনাকেই বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ব্রিটিশ সরকারের আমলারা। সেসময় মানুষ গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে খুব বেশি ভাবত না। গরু-ছাগল ইত্যাদি মাঠেঘাটে অবাধে বিচরণ করত। আর তাই গৃহপালিত ও বেওয়ারিশ গরু-ছাগলের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে আনতেই সরকার গবাদিপশু অনুপ্রবেশ আইন কার্যকর করে। এর ফলে প্রথমবারের মতো গবাদি পশুর মতো ব্যক্তিগত সম্পদেও সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বর্তমান আইন অনুযায়ী খোঁয়াড় ব্যবস্থা

১৮৭১ সালে গবাদি পশু অনাধিকার প্রবেশ আইন অনুযায়ী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে গবাদি পশুর খোঁয়াড় থাকবে। এক্ষেত্রে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শুকর, হাতি, উট, খচ্চর, গাধা ইত্যাদি প্রাণী গবাদি পশু হিসেবে বিবেচিত হবে। আইনে না থাকলেও হাঁস-মুরগিও খোঁয়াড়ে দেওয়ার চল রয়েছে।

২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ীও খোঁয়াড় ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের বিধান রয়েছে।

বর্তমানে ক্ষেত খাওয়ার অপরাধে কোনো কৃষক গরু নিয়ে খোঁয়ারে আসলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পান ২০ টাকা, ছাগলের জন্য পান ১০ টাকা। আর পশুর মালিক সেগুলো খোঁয়ার থেকে ছাড়িয়ে নিতে গরুর জন্য ১০০ টাকা, ছাগলের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা গুনেন। যতক্ষণ না পশুগুলোর মালিক সেগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলোকে খাবার-পানি খাওয়াতে হয়।

খোঁয়ার ইজারা দিতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে নিলামের ডাক দেওয়া হয়। বাংলা বছরের বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এক বছরের জন্য খোঁয়ার ইজারা দেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের মেম্বার ও ইউপি সচিবের সাথে আলোচনার পর নিলামের ডাক দেওয়া হয়। আগে মাইকিং করে খোঁয়ারের ডাক দেওয়া হলেও এখন তেমন দেখা যায় না। বর্তমানে কেউ খোঁয়ার নিতে আগ্রহী নয় বলে আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদেরই পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইজারায় সংগৃহীত অর্থ জমা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।

কেন বিলুপ্ত হচ্ছে খোঁয়াড়

খোঁয়াড় থেকে আর্থিক লাভ না হওয়াই খোঁয়াড় বিলুপ্তির মূল কারণ। এখন আর হাল দিতে বা পরিবহনের কাজে গরু-মহিষের দরকার পড়ে না। দুধ আর মাংসের জন্য আধুনিক পদ্ধতিতে গাভী ও ষাঁড় লালন-পালন করা হয়। আলাদা ঘর নির্মাণ করে সেখানেই গরু-ছাগল পালন করেন গবাদি পশুর মালিকরা। খাওয়ানো হয় পোল্ট্রি ফিড ও বিশেষ খাবার। এছাড়া ধানের আবাদ বিস্তৃতি লাভ করায় জমি আর অনাবাদি থাকছে না। ফলে আগের মতো গোচারণ ভূমিও নেই।

খোঁয়ার রক্ষকরা কী বলছেন

দিনাজপুর সদর উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে খোঁয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন অমল চন্দ্র রায়। তার স্ত্রী ছায়া রানী রায় শেখপুরা ইউনিয়নের ৪-৫-৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত নারী সদস্য। বর্তমানে অমল গাবুড়া হাটে চা-বিস্কুটের দোকান চালান। পাশেই রয়েছে তার খোঁয়ার।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আগে খোঁয়ার ডাক নিয়ে লাভ হতো, কিন্তু এখন আর লাভ নেই। গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি নিয়ে এখন আর কেউ আসে না। সবাই বাড়িতে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই গরু-ছাগল পালে। মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয় না বলে ক্ষেত খাওয়ার মতো ঘটনা খুব কম থাকে।'

অমল আরও বলেন, 'অন্য কেউ দায়িত্ব নিতে চান না বলে ইউনিয়ন থেকে বারবার আমাকেই দেওয়া হয়। প্রথমবার ১৪ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছিলাম। আর এ বছর ২ হাজার টাকায় নিয়েছি।'

দক্ষিন ঠাকুরগাঁওয়ে পূর্বে খোঁয়ার ইজারা নেওয়া আছির উদ্দীন বলেন, 'আকচা ইউনিয়ন থেকে আমাকে প্রায় ২০ বছর আগে পাঁচ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য খোয়ার ইজারা দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনো চেয়ারম্যান খোঁজ নেয় না। তিন বছর আগে বর্তমান চেয়ারম্যান আমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে সরকারকে জমা দিয়েছে। এখন আর কেউ আসে না।'

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী ইউনিয়নের মোজাফফর মোড়লও আগে একসময় খোঁয়াড় ইজারা নিতেন। তিনি বলেন, '৮-১০ বছর আগে আমার খোঁয়াড় ছিল। তখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বছর চুক্তিতে ৪-৫ হাজার টাকায় খোঁয়াড় কিনতে হতো। এখন গোচারণ ভূমি না থাকায় খোঁয়াড় উঠে গেছে।

স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য

খুলনা জেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সিন্ধু রায় জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খোঁয়াড় নিয়ে ইজারাদাররা গরু-ছাগলের মালিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিত। এতে প্রায়ই এলাকায় মারামারি, ঝগড়া, গণ্ডগোল লেগে থাকত। ফলে দীর্ঘদিন খোঁয়াড় ইজারা বন্ধ রয়েছে।

জেলার হরিঢালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মুজাহিদ হাজরা বলেন, 'আমাদের ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের মধ্যে পাঁচটি গ্রামে নামমাত্র খোঁয়াড় আছে। কিন্তু ভালো না চলায় কেউ আর খোঁয়াড় নেয় না।'

আগে খোঁয়াড় ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের উৎস হলেও এখন খোঁয়াড় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ খাত থেকে আর কোনো আয় হয় না বলে জানান খুলনার ভান্ডারপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান হিমাংসু বিশ্বাস। জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নে ১৪টি গ্রামের চারটি খোঁয়াড় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায় ইজারা দেওয়ার কথা জানান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. কওসার আলী জোয়ার্দার।

খুলনা জেলা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বিষ্ণুপদ পাল বলেন, 'আগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খোঁয়াড় ইজারা দেওয়া হতো। এখন গ্রামাঞ্চলে খোঁয়াড় প্রথা উঠে গেছে। বর্তমানে খুলনা জেলায় কতগুলো খোঁয়াড় আছে এবং সেখান থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আসে সে হিসাব খুলনা জেলা পরিষদে নেই।'

কুমিল্লাতেও সর্বশেষ কবে খোঁয়াড়ের ইজারা দেওয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, 'কুমিল্লায় কোনো খোঁয়াড় চালু আছে কি না, এমন তথ্য আমার কাছে নেই। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. নজরুল ইসলাম জানান, 'আমার জানামতে কুমিল্লায় পাঁচ-ছয় বছর পূর্বে এসব খোঁয়াড় বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রোভিশন করে গ্রাম্য চৌকিদারের মাধ্যমে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ হতো।'

ঠাকুরগাঁওয়ের আকচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মন দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাডকে বলেন, 'খোঁয়ার ইজারা নিতে এখন আর মানুষের আগ্রহ নেই। ইজারা দিতে চাইলেও কেউ আর ইজারা নিতে চায় না। ফলে পূর্বে যারা ইজারা নিয়েছে তাদের কাছেই খোঁয়ারগুলো থেকে গেছে।'

প্রতিবেদনটি তৈরিতে আমাদের খুলনা, কুমিল্লা, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি সহায়তা করেছেন।

তথ্যসূত্র: 

  • কৃষি সাহিত্য সংবাদ বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্র: কৃষক (১ম খণ্ড)। প্রকাশকাল: ১৯০০ সাল (১৩০৭ বঙ্গাব্দ)
  • কলোনাইজিং অ্যানিমেল, জনাথন সাহা
ছবি
প্রকাশের তারিখ
24/03/2024
আর্কাইভ তারিখ
07/07/2024